ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার
এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রামণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ গুলো দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বর একটি মশা বাহিত রোগ যা বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপনেবেশীয় অঞ্চলে হয়ে থাকে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু সংক্রামনের লক্ষ লক্ষ ঘটনা ঘটে থাকে। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন রোগীর ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাস স্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিনত হয়। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো কি কি?
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ যখন দেখা দেয় তখন সংক্রামিত মশা দ্বারা কামড়ের চার থেকে সাত দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণত শরিরের তাপমাত্রা অত্বাধিক বেড়ে যায়। জ্বর হয় ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট সাথে আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। সেগুলো হলো-
- মাথা ব্যাথা।
- পেশী, হাড় ও জয়েন্টে ব্যাথা।
- বমি বমি ভাব/বমি হওয়া।
- চোখের পেছনে ব্যাথা।
- গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
- শরিরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি হওয়া।
কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষন গুলো আরও খারাপ হয় এবং জীবনের উপর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। রক্তনালী গুলি প্রায়সই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফুটো হয়ে যায়।
ডেঙ্গু হেমোরজিক জ্বর বা গুরুত্বর ডেঙ্গু আপনার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা হয়েছে তা বুঝার জন্য কিছু লক্ষণ রয়েছে-
- সাংঘাতিক পেটে ব্যাথা।
- অবিরাম বমি বমি ভাব।
- আপনার মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হতে পারে।
- প্রসাব, পায়খানা বা বমির সাথে রক্ত যেতে পারে।
- ত্বকের নিচে রক্ত ক্ষরণ যা ক্ষতপ্রাপ্ত হতে পারে।
- শ্বাস নিতে কষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নেয়া।
- ঠান্ডা ত্বক।
- অবসাদ।
- বিরক্তি বা অস্থিরতা।
ডাক্তারের কাছে যাবেন কখন?
জ্বর হওয়ার পরে যদি আপনি এ সমস্ত লক্ষণ গুলো অনুভব করেন তাহলে নিকটস্থ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কারণ সমূহ
ডেঙ্গু জ্বর মশা দ্বারা ছড়িয়ে থাকা চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোন একটির কারণে হয়ে থাকে যা মানুষের আবাস্থল ও আশেপাশে সমৃদ্ধ হয়। একটি মশা যখন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে কামড় দেয়, তখন ভাইরাসটি মশার মধ্যে প্রবেশ করে। সংক্রামিত মশা যখন অন্য ব্যাক্তিকে কামড় দেয় তখন ভাইরাসটি সেই ব্যাক্তির রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে।
ডেঙ্গু জ্বর থেকে নিরাময়ের পরে আপনার যে ধরনের ভাইরাস সংক্রামিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তবে অন্য তিনটি ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের নয়। ডেঙ্গু হেমোরজিক ফিভার নামে পরিচিত মারাত্বক ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার ঝুঁকি প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি পায়, যদি আপনি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বার আক্রান্ত হন।
আরোও অনেক কারন রয়েছে যা আপনাকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে আসে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন অঞ্চলে বসবাস করলে বা ভ্রমণ করলে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় বা উপনিবেশিয় অঞ্চলে থাকার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হলো দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরিয় দীপপুঞ্জ, লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারাবিয়ান।
জটিলতা
গুরুতর ডেঙ্গু জ্বর ফুসফুস, যকৃত বা হার্টের ক্ষতি করতে পারে। রক্তচাপ বিপদজনক স্তরে নেমে যায়, যার ফলে শক এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিরোধ
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারি মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি সক্রিয় থাকে তবে রাতেও কামড়াতে পারে। এজন্য সবসময় মশারি টানিয়ে ঘুমাবেন। বাইরে বের হবার সময় ফুল হাতা শার্ট, ফুল প্যান্ট ও জুতা-মোজা পরিধান করুন।
এডিস মশার বংশ বিস্তারকে ধ্বংস করুন। আপনার বাসার আশেপাশের যে সব স্থানে পানি জমে থাকার জায়গা আছে সেসব জায়গা পরিষ্কার করুন। গাড়ির টায়ার, ফুলের টব, এসি/ফ্রিজের জমে থাকা পানি, ভাঙ্গা বোতল/বালতি, ছাদে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন নিয়মিত।
যে সব স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় সেসব স্থানে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন। অথবা মশা মারার ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করুন।
প্রচুর পরিমানে পানি,সরবত ইত্যাদি তরল খাবার পান করুন।
দিনের বেলায় ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন।
যদি সম্ভব হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকুন। পরিষ্কার, আলো বাতাস সম্পূর্ন এবং শুকনা ঘরে থাকবেন।
জ্বর আসলে মাথায় পানি দিবেন এবং ভেজা কাপড় দিয়ে শরির মুছে ফেলবেন।
ডেঙ্গু জ্বরের ওষুধ?
ডেনগভ্যাক্সিয়া, ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সি আক্রান্ত, যে অঞ্চলে আক্রান্তের প্রবনতা বেশি সে সকল অঞ্চলে দেয়ার অনুমতি রয়েছে। ১২ মাসে এই ভ্যাক্সিনের ৩টি ডোজ দেওয়া হয়। তবে ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ব্যবহারে সিথিলতা রয়েছে। তবে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন জোর দিয়ে বলেছে, যে সকল অঞ্চলে এ রোগটি সাধারণ ভাবে রয়েছে সেখানে ভ্যাক্সিনটির ব্যবহার এত জরুরি নয়। মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করাই আসল কাজ।
তাই আপাতত আপনি যদি এমন কোন অঞ্চলে করে থাকেন যেখানে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ রয়েছে, সেখানে ডেঙ্গু জ্বর এড়ানোর সর্বোওম উপায় হলো এ রোগটি মশা দ্বারা কামড়ানো না হওয়া এবং এর বংশ বিস্তারের জায়গা গুলোকে ধ্বংস করে দেয়া।
তথ্যসূত্র: মায়োক্লিনিক
প্রেস/জেএ/এনজে