আজঃ শুক্রবার ৩১-১০-২০২৫ ইং || খ্রিষ্টাব্দ

বাধা আর অবহেলায় আগুনের ভয়াবহতা

  • আপডেটেড: সোমবার ২০ Oct ২০২৫
  • / পঠিত : ২২ বার

বাধা আর অবহেলায় আগুনের ভয়াবহতা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের প্রধান বিমানবন্দর। এ বন্দরের কার্গো হাউসে গত শনিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর গতকাল বিকাল ৫টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। কারণ এমন স্পর্শকাতর একটি স্থানে অগ্নিদুর্ঘটনা শনাক্ত করার কোনো যন্ত্র নেই। আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেভানোর যন্ত্রও নেই। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে চিঠির পর চিঠি দেওয়া হলেও এতে কর্ণপাত করা হয়নি। উপরন্তু আগুন লাগার খবরে নির্বাপণের জন্য সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছলেও তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আধা ঘণ্টা পর জোর করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢোকে। ততক্ষণে আগুন কার্গো হাউসের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য।

এদিকে কার্গো হাউস পুড়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে আসা কয়েকশ টন পণ্য খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। এতে মূল্যবান এসব পণ্য নষ্ট বা চুরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ১২ সদস্যের একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটিকে আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, সিভিল এভিয়েশনের ফায়ার সিস্টেম পর্যাপ্ত না থাকায় আগুন দ্রুত নেভানো সম্ভব হয়নি। অগ্নিনির্বাপণে সরকারের সক্ষমতা-অক্ষমতার প্রশ্নের পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানেরও দায় রয়ে যায়। সেটাও দেখব আমরা। তিনি যোগ করেন, বহু স্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকর নয়।

শাহজালালের অগ্নিকাণ্ডে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। এ ধরনের ঘটনার পরিপূর্ণ তদন্তের প্রযুক্তিগত সাপোর্টও নেই। আমরা আশা করছি, কোর কমিটির কাছ থেকে একটা পরিচ্ছন্ন রিপোর্ট পাব। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় দেশের বাইরে থেকে উন্নত প্রযুক্তি আনার পরিকল্পনাও রয়েছে, জানান তিনি।

বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৫০০ টন পণ্য আমদানি হয়। পুড়ে যাওয়ার ফলে কার্গো গুদামটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এটা কবে নাগাদ ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে, তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারছেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নবনির্মিত থার্ড টার্মিনালের কার্গো ভবনটির ৯ নম্বর গেট দিয়ে সীমিত আকারে মালামাল ডেলিভারির কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। থার্ড টার্মিনালে শুল্কায়নের জন্য যন্ত্রপাতি বসাতেও সময় লাগবে। কোন প্রক্রিয়ায় মালামাল খালাস হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে, বলেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল আমিন শেখ বলেন, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ আপাতত জিএসই মেনটেন্যান্স নামক স্থানে পণ্য রাখার জন্য স্থান নির্ধারণ করেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করছে। ৯ নম্বর গেটে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ওই গেট দিয়ে পণ্যের খালাস প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হচ্ছে।

সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব এক অগ্নিনির্বাপণকর্মী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের অগ্নিনির্বাপক গাড়িটি বিমানবন্দরের রানওয়েতে ছিল। বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের বার্তা পাওয়ার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি নিয়ে যাই। গিয়ে দেখি, মেডিসিন গোডাউন থেকে আগুনের ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কিন্তু রানওয়ের ভেতরে মালামালের স্তূপ থাকায় গোডাউনের কাছে যেতে পারিনি। পরে অতিরিক্ত পাইপ দিয়েও আগুনের কাছে পানি পৌঁছানো যায়নি। ইচ্ছা করলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মালামাল সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে আমাদের সহযোগিতা করতে পারত। কিন্তু তারা কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে কোনো সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম ছিল না। কাস্টমস হাউসের অংশেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ভবনটি বিভিন্ন ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে প্রচুর দাহ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান ছিল। এ জন্য অকুপেন্সি লোড অনেক বেশি ছিল এবং নির্বাপণে সময় লেগেছে।

তাজুল ইসলাম আরও জানান, ভবনটি স্টিলের কাঠামোতে নির্মিত, যা আগুনের তাপ শোষণ করে রাখায় এখনও ধীরে ধীরে তাপ ছাড়ছে। বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, তবে কোনো শিখা বা নতুন আগুনের আশঙ্কা নেই। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট সতর্ক অবস্থানে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ধোঁয়া দেখা যায়।

তাজুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে থাকা ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য থেকে কিছু বাইপ্রোডাক্ট কেমিক্যাল তৈরি হতে পারে, তবে এটা মিরপুরের কেমিক্যাল গোডাউনের মতো উচ্চ তেজস্ক্রিয় হবে না। বাতাসে এখন পর্যন্ত বিপজ্জনক কোনো তেজস্ত্রিয় মাত্রা শনাক্ত হয়নি।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একাধিক টিম বিমানবন্দরে পৌঁছায়। তারা কার্গো হাউসের গেটে যাওয়ার জন্য ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে পৌঁছলে সেখানে বাধা দেওয়া হয়। প্রায় ৩০ মিনিট তারা সেখানে অবস্থান করেন। ততক্ষণে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দাউ দাউ আগুনের শিখা ও কালো ধোঁয়ায় বিমানবন্দর ছেয়ে যায়। এরপর উত্তেজিত জনতা ৮ নম্বর গেটের পাশের গেট ভেঙে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

অবশ্য সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (অপারেশন) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান আমাদের সময়কে বলেন, যথাসময়ে ফায়ার সার্ভিসকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। একটি পক্ষ সিভিল এভিয়েশনের বিরুদ্ধে অপ্রচার চালাচ্ছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ঘটনাস্থলে থাকা কুরিয়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তাও। ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের ইনচার্জ পরিচয় দিয়ে ওই প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বলেন, প্রথমে আমাদের কুরিয়ার সার্ভিসের পাশের জায়গা থেকে আগুন লাগে। প্রায় দেড় ঘণ্টা আগুন জ্বললেও তখনও সেটা ছড়ায়নি। এর মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট আসে। কিন্তু তাদের কুরিয়ার সার্ভিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমরা ভেতরে গিয়ে আগুন নেভানোর জন্য চাপ দিই। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস জানায়, তারা ভেতরে ঢোকার পারমিশন পাচ্ছে না। যদি শুরুতেই ভেতরে ঢুকে পানি দেওয়া যেত, তাহলে আগুন এত ভয়াবহ হতো না।

কার্গো হাউসের কিউইপি-এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মো. সাইদ হোসেন বলেন, দুপুর সোয়া ২টায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে। কিন্তু তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি।

আগুন নিয়ন্ত্রণে বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছেছি। কোথাও কোনো বাধা বা বিলম্ব হয়নি।

বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার গার্মেন্টস পণ্য, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের শিপমেন্ট পুড়ে গেছে। এ ঘটনায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে অসংখ্য আমদানিকারক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাদের আশঙ্কা, ভয়াবহ এ আগুনে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগুনে শুধু তাদের আর্থিক ক্ষতিই হয়নি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অর্ডারেরও (ক্রয়াদেশ) ক্ষতি হবে। এতে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পর্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাণিজ্য উপদেষ্টা গতকাল বিমানবন্দরের কার্গো হাউস কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন বেসরকারি বিমান, পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। পরিদর্শন শেষে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আগুনে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা অর্থমূল্য ও ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি খাতভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতিরও হিসাব করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসকে অনুমতি না দেওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হয়েছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার অভিযোগটি সঠিক নয়। বিমানবন্দরের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণে যারা ছিলেন, তারা ঘটনার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই কাজ শুরু করেছিলেন।


নিউজ কমেন্ট করার জন্য প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে লগইন করুন

Copyright © 2025. All right reserved OnlinePress24
Theme Developed BY Global Seba